নৌ বিদ্রোহ

নৌ বিদ্রোহের সূচনা

  • ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ই ফেব্রুয়ারি তলোয়ার জাহাজে 'জয় হিন্দ' কথাটি লেখার অপরাধে বিদ্রোহের অন্যতম নায়ক রেডিও অপারেটর শ্রী বলাই দত্তকে গ্রেফতার করা হলে নৌ বিদ্রোহের সৃষ্টি হয়।
  • এর প্রতিবাদে রয়্যাল ইন্ডিয়ান নেভির প্রধান এম. এস. খানের নেতৃত্বে ১৫০০ নাবিক বিদ্রোহ ঘােষণা করে ( ১৮ ফেব্রুয়ারি ) ।
  • বােম্বাইয়ের ২২ টি জাহাজে এবং করাচির হিন্দুস্থান জাহাজে এই বিদ্রোহের সূচনা ঘটে।

নৌ বিদ্রোহের কারণ

  • বেতন বৈষম্য : সমযােগ্যতা সত্ত্বেও ভারতীয় নৌ কর্মচারীদের কখনােই ব্রিটিশ কর্মচারীদের সমপরিমাণ বেতন দেওয়া হত না । একই কাজে এই ধরনের বৈষম্যে ভারতীয় নৌসেনাদের মনে ক্ষোভের সঞ্চার হয় ।
  • নিম্নমানের খাদ্য সরবরাহ : ইউরোপীয় নাবিকরা উত্কৃষ্ট মনের খাবার পেলেও ভারতীয় নাবিকদের জন্য নিকৃষ্টমনের খাবার সরবরাহ করা হত । বহুবার ভালাে খাবারের আবেদন করেও ভারতীয় নৌসেনারা তা পায়নি , ফলে তাদের মনে এক ক্ষোভ পুঞ্জীভূত হয়েছিল ।
  • বৈষম্যমূলক আচরণ : বিপজ্জনক কেন্দ্রে যেখানে মৃত্যুর ঝুঁকি অপেক্ষাকৃত বেশি সেখানে বেছে বেছে ভারতীয় নাবিকদেরই পাঠানো হত ।
  • জাতি বৈষম্য :নৌসেনাবাহিনীতে জাতিগত বিদ্বেষের কারণে ইংরেজ নৌ-অফিসাররা ভারতীয় নাবিকদের অকারণে গালিগালাজ, অপমান ও খারাপ ব্যবহার করত। ব্রিটিশ উচ্চপদস্থ কমান্ডার এফ. ডব্লিউ. কিং ভারতীয়দের প্রতি জাতিগত কুৎসা রটালে তা ভারতীয় নৌসেনাদের মনে যথেষ্ট অসন্তোষ সৃষ্টি করে ।
  • বিভেদ মূলক আচরণ :ব্রিটিশ পদস্থ নৌ কর্মচারীদের বিভেদ মূলক আচরণের জন্য নৌবাহিনী দুটি বিভাগে বিভাজিত হয় । ইংরেজ শেতাঙ্গ সম্প্রদায় ‘ British Other Ranks ‘ ( B.O.R ) নামে পরিচিতি পায় , আর ভারতীয় নৌ কর্মচারীরা ‘ Indian Other Ranks ‘ ( I.O.R ) নামে পরিচিতি পায় এবং তাদেরকে উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের স্বেচ্ছাচারিতার শিকার হতে হয় ।
  • পদোন্নতির সুযোগ না থাকা :ভারতীয় নৌকর্মচারীদের কোনােদিনই পদোন্নতি হত না। চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পরে ভারতীয় নৌসেনাদের পুনর্বাসনের কোনাে ব্যবস্থা ছিল না।
  • সেনা ছাঁটাই : দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের সময় প্রচুর নৌসেনা নিয়োগ করা হয়। কিন্তু যুদ্ধ শেষে তাদের বিনা কারণে বরখাস্ত করে।
  • দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রভাব ঃ দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে ভারতীয় নৌবাহিনীর সেনাদের দক্ষিণ – পূর্ব ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন দেশে যুদ্ধের জন্য পাঠানাে হয়েছিল । এই সময় তারা বিভিন্ন দেশের জাতীয়তাবাদী আন্দোলনের দ্বারা ব্যাপকভাবে প্রভাবিত হয়েছিল । ফলে তাদের মনে বিদ্রোহের মানসিকতা জন্মায় । বিশ্বযুদ্ধ শেষে দেশে ফিরে তারাও স্বাধীনতার আকাঙ্ক্ষায় উগ্রীব হয়ে ওঠে।
  • ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রাম : ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতার সংগ্রাম দমনে যে সকল ভারতীয় নৌসেনা পাঠানাে হয়েছিল । তাদের দেশে ফিরিয়ে আনার দাবিও তারা জানায় । তারা ইন্দোনেশিয়ার স্বাধীনতা সংগ্রামীদের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করতে অস্বীকার করে ।
  • আই. এন. এ সেনাদের বিচার :যুদ্ধবন্দি আইনে আই. এন. এ -র তিন সেনাপতি গুরুদয়াল সিং ধিলোঁ , প্রেম সায়গল , শাহনওয়াজ খানকে দিল্লির লালকেল্লায় নিয়ে আসা হয় প্রকাশ্য বিচারের জন্য । ৫৭ দিন ধরে চলা এই মামলায় ( ৫ নভেম্বর – ৩১ ডিসেম্বর , ১৯৪৫ খ্রি. ) আজাদ হিন্দ সেনাদের বীরত্বপূর্ণ লড়াই ও আত্মত্যাগের কাহিনি প্রকাশিত হয় , যা নৌসেনাদের উদ্বুদ্ধ করে ।

নৌ বিদ্রোহের প্রসার

  • ১৯৪৬ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ই ফেব্রুয়ারি 'রয়াল ইন্ডিয়ান নেভি'র প্রধান এম.এস. খানের নেতৃত্বে বোম্বের তলোয়ার নামক যুদ্ধ জাহাজের ভারতীয় নাবিকগণ প্রথম বিদ্রোহ শুরু করেন ।
  • ক্রমে আরও ২২টি জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে।
  • এই উপলক্ষে বোম্বাই শহরে বিক্ষোভ শুরু হয় । ক্রমে সেই বিক্ষোভ বোম্বাই উপকূলস্থ অন্যান্য জাহাজে ছড়িয়ে পড়ে ।
  • বিদ্রোহীরা ‘ তলােয়ার ’ জাহাজের নাম পালটে রাখে ‘ ইন্ডিয়ান ন্যাশনাল নেভি ’ ।
  • জাহাজের ইউনিয়ন জ্যাকের পতাকা নামিয়ে টাঙিয়ে দেয় জাতীয় কংগ্রেস , কমিউনিস্ট পার্টি ও মুসলিম লিগের পতাকা ।
  • আস্তে আস্তে মাদ্রাজ , কলকাতা , করাচি ও কোচিন বন্দরেও বিদ্রোহের আগুন ছড়িয়ে পড়ে ।
  • নৌ-বিদ্রোহ দমনে ব্রিটিশ সরকার ভারতীয় স্থলবাহিনীকে নিয়োগ করেন । ভারতীয় স্থলবাহিনী সহভারতীয় যোদ্ধাদের বিরুদ্ধে অস্ত্রধারণ করতে অস্বীকার করেন । তখন ব্রিটিশ সৈন্যগণ ভারতীয় সেনাদের দমনে এগিয়ে আসেন ।
  • সরকারি কর্মী, শ্রমিক, কৃষক, ছাত্র ও সাধারণ জনগণ বিদ্রোহীদের সমর্থনে এগিয়ে আসায় বিদ্রোহ আরও ব্যাপক আকার ধারণ করে ।

স্ট্রাইক কমিটির দাবিবিদ্রোহীরা নৌ সংগ্রাম পরিচালনা ও বিভিন্ন বিদ্রোহী কেন্দ্রের মধ্যে সমন্বয় সাধনের জন্য একজোট হয়ে নৌসেনা কেন্দ্রীয় ধর্মঘট সমিতি ( Naval Central Strike Committee ) গঠন করে ( ১৯ ফেব্রুয়ারি ) । এই কমিটির প্রেসিডেন্ট হন এম. এস. খান , ভাইস-প্রেসিডেন্ট হন মদন সিং । স্ট্রাইক কমিটি বেশ কিছু দাবি ব্রিটিশ কর্তৃপক্ষের কাছে পেশ করে । দাবিগুলি হল—

  • আই. এন. এ সেনাদের ও অন্যান্য রাজনৈতিক বন্দিদের মুক্তি দান ।
  • তলােয়ার জাহাজের সেনাপ্রধান ( কমান্ডার ) এফ. ডব্লিউ. কিং – এর বিরুদ্ধে শাস্তিগ্রহণ ।
  • ভারতীয় নৌসেনাদের চাকরির মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার পর তাদের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা করা ।
  • মাল্লা ও মাঝিদের বেতন , ভাতা ইত্যাদির হার বাড়িয়ে ব্রিটিশ কর্মচারীদের সমান করা ।
  • উন্নতমানের খাবারের ব্যবস্থা করা ।
  • ইন্দোনেশিয়া থেকে ভারতীয় সেনাদের ফিরিয়ে আনা ।
  • ক্যান্টিনে ব্রিটিশ ও ভারতীয় নাবিকদের মধ্যে বৈষম্যের অবসান ঘটানাে ।
  • নৌবাহিনী ছেড়ে যাওয়ার সময় পােশাক ফেরত না নেওয়া ।

নৌসেনা কেন্দ্রীয় ধর্মঘট সমিতি সিদ্ধান্ত ঘােষণা করে বলে— “ এখন থেকে নৌবাহিনীর নাবিকরা শুধুমাত্র জাতীয় নেতাদের নির্দেশই গ্রহণ করবে ” ( Henceforth the ratings of the RIN will take orders only from national leders . ) ।

ব্যর্থতার কারণ :অল্প সময়ে তুমুল আলোড়ন সৃষ্টি করলেও এই বিদ্রোহ শেষ পর্যন্ত ব্যর্থ হয়ে ছিল। কারণ --

  • জাতীয় নেতাদের বিরোধিতা : কংগ্রেসের অনেক নেতা এই বিদ্রোহকে সমর্থন করে নি। নেহেরু, সর্দার প্যাটেল, গান্ধিজি প্রমুখ নেতা বিদ্রোহীদের সমালোচনা করেন।
  • বিমান হানার ভয় :২১ ফেব্রুয়ারি ব্রিটিশ সেনাবাহিনী সরাসরি বিদ্রোহীদের সঙ্গে সংঘর্ষে নামে । বিদ্রোহ নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ হলে নৌ সেনাধ্যক্ষ অ্যাডমিরাল গডফ্রের নির্দেশে ডক অঞ্চলে বিমান থেকে গােলা বর্ষণ করা হয় ।
  • বল্লভভাই এর মধ্যস্ততা : সর্দার প্যাটেল সরকার ও বিদ্রোহীদের মধ্যে মধ্যস্থতার প্রস্তাব আনলে বিদ্রোহীরা আত্মসমর্পণ করে। বিদ্রোহীরা ঘােষণা করে , আমরা আত্মসমর্পণ করছি ব্রিটিশের কাছে নয় , ভারতের কাছে ( ‘ We surrender to India not to Britain ‘ ) ।

নৌ বিদ্রোহের গুরুত্ব বা ফলাফল

  • আলাপ আলোচনার উপর গুরুত্ব দান : নৌ বিদ্রোহের গুরুত্ব উপলদ্ধি করেই ব্রিটিশ এই প্রথম সামরিক শক্তির সাহায্য না নিয়ে আলাপ আলােচনার মাধ্যমে ক্ষমতা হস্তান্তরের ওপর ব্রিটিশ গুরুত্ব আরােপ করতে শুরু করে ।
  • ব্রিটিশ বোধোদয় :সিপাহি বিদ্রোহে প্রথম এবং নৌ বিদ্রোহে শেষবারের মতাে ভারতীয় সেনারা ব্রিটিশের বিরুদ্ধে যেভাবে বিদ্রোহী হয়েছিল তাতে ব্রিটিশ বুঝেছিল শুধু সাধারণ ভারতীয়রাই নয় , সৈন্যরাও ইংরেজদের বিরােধী হয়ে উঠেছেন । এর ফলে ব্রিটিশ সরকার উপলব্ধি করে যে ভারতীয় সেনাবাহিনীর ওপর আর নির্ভর করে যাবে না ।
  • স্বাধীনতা দানের সিদ্ধান্ত : নৌ বিদ্রোহের জন্যই ব্রিটিশ প্রশাসন ক্ষমতা হস্তান্তরের অর্থাৎ ভারতকে স্বাধীনতা প্রদানের সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল । তড়িঘড়ি তারা ক্যাবিনেট মিশন বা মন্ত্রী মিশন ভারতে পাঠাতে বাধ্য হয়েছিল ।
  • ব্রিটিশ ভীতির অবসান :নৌ সেনাদের বিদ্রোহ সাধারণ মানুষের মনে ব্রিটিশ ভীতি ঘুচিয়েছিল । দেশীয় সেনা ও সাধারণ প্রজাদের মধ্যে ব্যবধান দূর হয়েছিল ।
  • হিন্দু মুসলিম ঐক্য :নৌ বিদ্রোহে হিন্দু – মুসলিম ঐক্যের উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত স্থাপিত হয়েছিল ।